বই : কবি ও রহস্যময়ী
লেখক : বিশ্বজিৎ চৌধুরী
পাঠ প্রতিক্রিয়া :
“দেখো, অঙ্কে জাদু নেই, কবিতায় আছে। কবি ও কবিতার এই মায়াজাল কাটিয়ে উঠা বড় কঠিন” হ্যাঁ, ঠিক এই কথা বলেই রহস্যময়ীকে সতর্ক করে দেন শিক্ষক ড. নলিনীমোহন বসু। বলা বাহুল্য, ছাত্রীকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোই ছিল শিক্ষকের একমাত্র ইচ্ছা। তবে এ তো আর অঙ্ক নয়, যে সুচিন্তিত মস্তিষ্কের দ্বারা সমাধান হবে ; ভালোবাসা- সকল হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে, অদৃশ্য শক্তি-বলে কোথায় নিয়ে ফেলবে, কে বলতে পারে !
কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর ফজিলাতুন্নেছার মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কটিই মূল বিষয় হলেও, সমসাময়িক নানা ঘটনাবলীও স্থান পেয়েছে এ বইতে । চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা, অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সংগ্রামের জন্য ফজিলতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারা যায় না । আবার এই ‘রহস্যময়ী’ তার রহস্যের মাধ্যমে দুর্বোধ্য ‘নারী’ চরিত্রকেও যেন তুলে ধরেছে সুনিপুনভাবে । তাছাড়া উৎসুক পাঠক এখানে স্ত্রী-সংসার বিমুখ ছন্নছাড়া এক কবিকেও আবিস্কার করতে পারবেন ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছা । মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে কবিকে দেখেই এক ধরনের মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল তাঁর প্রতি, কি করে একান্তে আলাপ করা যায় তারই সুযোগ খুঁজতে থাকেন মনে মনে। এদিকে নজরুল ও কম যান না ! ঘন ঘন প্রেমে পড়াটা তো তার কাছে স্বাভাবিকই ! কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেই সমাজে একটি মুসলিম রমণীকে মঞ্চে দৃঢ় কণ্ঠে প্রবন্ধ পাঠ করতে দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, এ অন্য ধাঁচে গড়া ; অনুরাগ জন্মেছিল তাঁর মনেও !
কবির পুরোনো বন্ধু মোতাহার হোসেনের মাধ্যমেই শুরু হয়ে গেল যোগাযোগ। এদিকে ফজিলত তো প্রিয় কবিকে কাছে পেয়ে হস্তরেখা দেখিয়ে নেওয়ার লোভও সামলাতে পারেন নি। লক্ষ্য সম্পর্কে যতই সচেতন হোন না কেন, হৃদয়ের ঝঙ্কারকে কি আর চেপে রাখা যায় ! কবিও হাত দেখলেন সময় নিয়ে, তারপরে, কিছু না বলে শুধু খাতায় কি সব টুকে নিলেন ; পরবর্তীতে গল্প করার একটা উপলক্ষ তো পাওয়া গেল ! তারপর আর কি, বন্ধু মোতিহারকে ফেলে একাই যাতায়াত শুরু করে দিলেন রহস্যময়ীর বাসায় । তবে বাধ সাজার জন্য তো মূর্তমান বেরসিকের মতো একজন রয়েই গেলেন- নলিনী মোহন বাবু, ঐ যে অঙ্কের টিচার !
অঙ্কের মাস্টার ফজিলতকে হয়তো বেধে রাখতে পারেন কিন্তু বাঁধনহারা নজরুলকে কি আর আটকে রাখা যায় ? ভালোবাসার স্বরূপ উপলব্ধি করতে কবি চলে এলেন ফজিলতের কাছে, গভীর রাতে, একা, বুঝতে চাইলেন তার মনোবাঞ্ছা, আর এখানেই ধাক্কা খেয়ে বেদনার অতল সাগরে যেন ডুবে গেলেন তিনি ! বিদায় নিলেন ফজিলতের কাছ থেকে । রেখে গেলেন বেদনা ভেজা ছোট্ট কবিতা
‘সুন্দর বেশে মৃত্যু আমার আসিলে কি এত দিনে?
বাজালে দুপুরে বিদায় পূরবী আমার জীবন বীণে।
ভয় নাই রাণী রেখে গেনু শুধু চোখের জলের লেখা
রাতের এ লেখা শুকাবে প্রভাতে চলে যাই আমি একা’।
কিন্তু ফজিলাতুন্নেছা, যিনি নিজেই নজরুলের প্রতি মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন, কেনই বা তিনি কবিকে ওভাবে অগ্রাহ্য করলেন ? তা কি কেবলই কবি বিবাহিত বলে নাকি তিনি কবির ভালোবাসার প্রতি সন্দিহান ? আসলে, ফজিলত জানতেন, তার দিকে তাকিয়ে আছে গোটা মুসলিম বাংলা। যে সংগ্রামী জীবন তিনি কাটিয়ে এসেছেন তারপর এখানে থেমে গেলে তা হবে অত্যন্ত বেমানান, সমাজে নানারকম কটুক্তি হবে, আর ধর্মান্ধ মোল্লাদের জন্য তা হবে বিজয়স্বরূপ যার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে আগামী দিনের সকল মুসলিম নারীকে । অন্যদিকে, তার সাফল্য দেখেই তো এগিয়ে আসবে পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিম তরুণীরা।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ কীভাবে নারীদের বঞ্চিত করে রাখতো সেদিকটিও লেখক তুলে ধরেছেন তাঁর সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে। অসংখ্য মেধাবী ছাত্রকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশে পাঠাচ্ছে, তখন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট রেজাল্টের পরও ফজিলতকে স্কলারশিপ দেওয়া হচ্ছিল না সে নারী বলে। তবে নলিনীমোহন বাবু জানতেন যে বিশেষ কারণটি এর পিছনে লুকিয়ে ছিল এবং যে জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজিলাতুন্নেছাকে স্কলারশিপ দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে তা হলো সে মুসলিম ! পাছে মোল্লারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অধর্ম করার অভিযোগ আনে ! তবে, অবশেষে এই সংগ্রামী নারী সফল হয়েছেন, পেয়েছেন বিলাতে যাওয়ার সুযোগ, নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।
আচ্ছা, কবির ভালোবাসা কি তবে একপাক্ষিক ছিল ? বই টি শেষ অবধি পড়লে, এর উত্তর নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। আসলে দুর্বোধ্য নারী চরিত্র বোঝাই দায় ! মোতাহার হোসেন যথার্থই মন্তব্য করেন,
“যে লোকটা বেতালে পা ফেলে না, তাকে নিয়ে অনায়াসে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে আর যে লোকটার পা হড়কে গেল তার কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে ছাড়ছে না। এই বোধহয় নারী চরিত্র “!
এমনকি নজরুল তার সঞ্চিতা কাব্যগ্রন্থটি ফজিলাতুন্নেছা কে উৎসর্গ করতে চাইলে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। মনের ভাবখানা যেন এমন “আমি কিশোর দোলন নই যে বইয়ের মলাটে মুদ্রিত হরফে নিজের নাম দেখেই সংসার-সমাজ ভুলে যাবো “ ! কিন্তু সেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, গায়ের রঙ উজ্জ্বল নয় বলে যার মধ্যে এক প্রকার আক্ষেপ ছিল, কবির ভাষা আর কথাতে সেই রং ই তার মধ্যে জাগিয়ে তোলে অপার মহিমা । বলে উঠেন, “কবিদের আবেগটাই বোধহয় এ রকম, বিদ্রোহের হুংকার আর বিরহের হাহাকার – সবটাতেই বাড়াবাড়ি” তাছাড়া কবি যখন জানতে চাইলেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে তার কথা মনে রইবে কি না ? রহস্যময়ীর উত্তর ছিল “আপনার দেওয়া গানের খাতাটা সঙ্গে রইল আমার ” ! সবশেষ, ট্রেন ছাড়ার মুহুর্তে কবিকে একনজর দেখার যে সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা ছাড়া আর কোন শব্দ দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে !
আর কবির যেমন মনোভাব, “আমি কবি, আমি জানি কী করে সুন্দরের বুকে ফুল ফোটাতে হয়”, যথার্থই ফুল ফুটিয়েছেন তিনি । ফজিলতকে ছেড়ে দিয়েছেন তার নিজের মতো ; সাহিত্য পেয়েছে তাঁর সেরা প্রেমের কবিতা ‘রহস্যময়ী’, ফজিলতের বিদায় উপলক্ষে রচিত ‘বর্ষা বিদায়’ সহ অসংখ্য কবিতা এবং গাণ। আর নিয়তির কাছে আপন মিলনকে ত্যাগ করে সৃষ্টি করেছেন অকৃত্রিম ভালোবাসার এক সুমহান দৃষ্টান্ত !
লেখক:
মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ,
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।